সেনাবাহিনীর ওপর মানুষের এত আস্থা কেন?

দেশের ক্রান্তিলগ্নে, দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের এত আস্থা এত বিশ্বাস কেন? কোনও কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই রাতারাতি অহেতুক এ বিশ্বাস তৈরি হয়নি! দেশ ও দেশের বাইরে নানা অর্জনের মাধ্যমে এ বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে দেশপ্রেমিক এই সশস্ত্র বাহিনীটি। গত এক দশকে দেশে-বিদেশে তারা ব্যাপক সুনাম কুঁড়িয়েছে। যখন আইন-আদালত, প্রশাসন, কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কারোও প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে পারছে না, যখন ‘পলিটিক্যাল ব্লেম গেম’ নিয়ে মত্ত রাজনৈতিক শিবিরগুলো, তখনই বারবার সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ এসেছে। তাদের ওপর ভরসা রাখতে হয়েছে। সংকটকালে বহুবার এমন আস্থার যথাযথ প্রতিদানও দিয়েছে সেনারা। এবারও বিশেষত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রসঙ্গটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্ত প্রহরী। সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ আসলে নানা বিতর্ক ও ভীতির বিষয় চলে আসলেও, বলতে হয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। তাই তাদের প্রতি আস্থা ও ভরসাও আছে সাধারণ জনগণের।

পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের মাধ্যমে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে সেনাবাহিনী শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করছে। সেনাবাহিনীর মহান অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলাকে ওই দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। যা বিশ্বে বিরল অর্জন। কেননা বাংলা ভাষা বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্য ব্যতীত অন্য কোথাও নেই। তখনই প্রথম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবদানকে সম্মান দেখিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার জাতিগত দাঙ্গায় আক্রান্ত আইভরিকোস্ট তার প্রধান ব্যস্ততম সড়কের নাম রেখেছে ‘বাংলাদেশ সড়ক’। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৭১ টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১,২৬,৪৮৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে ৮,৮৪১ জন কর্মরত রয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনের মাধ্যমে এ অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় দেড়শ শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছে।

কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া,পূর্ব-তিমুরে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা, সড়ক ও স্থাপনা নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি উজ্জ্বল নাম। সেন্ট্রাল আফ্রিকায় চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার, সেলেকা ও এন্টি বলাকার মধ্যে জাতিগত সংঘাত নিরসনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনসহ বিশ্ব নেতারা বারবার শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।

তেমনিভাবে বাংলাদেশের দুর্গম অঞ্চলে, জলে কিংবা অরণ্যে সেনা বাহিনী কাজ করছে সততা, নিষ্ঠার সাথে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা পাহাড় ধস থেকে মানুষ বাঁচাতে বিলিয়ে দিয়েছে তাজা প্রাণ। এমনকি শিক্ষা, চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সেনা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান সুনাম কুড়িয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, সেতু তৈরির দায়িত্ব পড়ে সেনাবাহিনীর ওপর। দেশের বড় বড় সংকটগুলো মোকাবিলায় দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে। বর্তমানেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে সেনাবাহিনী ওপর। পাসপোর্ট অফিস, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান, পদ্মা সেতু, ঢাকা-মাওয়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক নির্মাণ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণসহ সার্বিক নিরাপত্তায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তখন তদারকির দায়িত্ব পড়ে সেনাবাহিনীর ওপর।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বস্ততা, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিশ্চিত হয়নি। কোনও দলই কাউকে বিশ্বাস করছে না। তাই ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী কাজ করছে। পুলিশ-প্রশাসনকে সহায়তা করলেও সেনাবাহিনী নির্বাচন পরিস্থিতি শান্ত ও সহযোগিতামূলক করেছে। যখনই পুলিশ প্রশাসন জনগণের আস্থা হারিয়েছে, বিতর্কিত হয়েছে তখনই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীকে রোল মডেল করা হয়েছে। প্রতিবারই নির্বাচন আসলেই বিরোধীদলগুলো কারোও প্রতি আস্থা না রাখতে পারলেও সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রেখেছে। কারণ সেনাবাহিনী দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের পদ্ধতি বা সুযোগ নেই। তাদের গৌরবজ্জ্বল অর্জনেরও অভাব নেই। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি সর্বাধিক আলোচনায় আসছে।

আমাদেরকে বাস্তবতা মানতেই হবে, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট হলো- একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। এ নির্বাচনের শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে যেমন সংশয় রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সন্দেহ রয়েছে। এ সংশয়-সন্দেহ শুধু বিরোধীদলগুলোর নয় বরং সরকারি দলের মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু এরপরেও নানা সমীকরণের কারণে সরকার সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করছে। সহিংসতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি যে সরকারি দলের মাঝেও রয়েছে তা আওয়ামী লীগের বরেণ্য নেতা তোফায়েল আহমেদ ও ওবায়দুল কাদেরের বক্তেব্যেই স্পষ্ট।

সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।’ তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, ‘ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হবে।’ তার মানে নির্বাচন নিয়ে সবদলের তো বটেই সরকারেরও ভীতি আছে- আপাতভাবে এটা স্পষ্ট।

এদিকে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পূর্বের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে প্রকাশ্যে সহিংসতা, ব্যালটপেপার ছিনতাই হয়েছে। তখন যদি পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতো তাহলে অন্তত এত মানুষের প্রাণহানি ও এত বিশৃঙ্খল অবস্থা হতো না। সেসময় কোনও ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারায় পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়েছে জনগণ। সুতরাং জাতীয় সংসদের মত এতবড় ক্ষমতার পালাবদলের নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন ছাড়া কোনও ভালো বিকল্প নেই। কারণ অতীতে যখনই এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কাজ করেছে তখনই পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছে। হানাহানি, কেন্দ্র দখল ও কারচুপির ঘটনা কমে গেছে।

তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ও সহিংসতার ঝুঁকিটি সবার মাথায় আসলেও ‘সেনাবাহিনী আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা হস্তক্ষেপের সাহস করতে পারে’-এ ভীতি দেখিয়ে অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে! কার্যত বাংলাদেশের ইতিহাস বলে ক্ষমতা হস্তক্ষেপের কথা বললেও ইতোপূর্বে কোনও নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেনাবাহিনী কখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সেনাবাহিনীর একটি শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা আছে বলে সবাই বিশ্বাস করছে।

দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। অথচ এখনও পর্যন্ত বিরোধী দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছে না। হাজার হাজার নেতাকর্মী, প্রার্থী, ভোটার মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন। অনেকে গ্রামছাড়াও হয়েছে। সহিংসতায় হতাহতের অভিযোগ আছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নেই- এ মর্মে অনেক সামাজিক সংগঠনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি খোদ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও প্রশ্ন তুলেছেন।

এমতাবস্থায় শান্তিপ্রিয় জনগণ সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখছে। সেনাবাহিনী মাঠে নামলে আবার পরিস্থিতি শান্ত হবে, পালাতকরা বাড়িঘরে ফিরবে, প্রার্থীরা সমান তালে কাজ করবে, জনগণ নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে- এমন আশা দেশবাসীর।

তবে সর্বোপরি একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচনকেন্দ্রিক অরাজকতা সৃষ্টি হলে দেশে সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে। বহির্বিশ্বে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ সুযোগে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাতে দেখা দিতে পারে জাতীয় অর্থনৈতিক সংকটও। আমদানি-রফতানি সংকট দেখা দেবে, পোশাক খাত ঝুঁকিতে পড়বে, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হুমকির মুখে পড়বে। বিদেশি ইস্টারেস্ট গ্রুপ সুযোগ নিতে চাইবে। তখন আমাদের অথনৈতিক প্রবাহ ও নিরাপত্তা সংকট দেখা দিবে। সুতরাং দেশের স্বার্থে সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনা করে যে কোনও উপায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই।

শেষোক্তিতে বলা যায়, যখন আমাদের সেনাবাহিনী সারা বিশ্বে এর চেয়ে বড় বড় সংকট মোকাবিলা করে ‘বিশ্ব মানবতার রোল মড়েল’এ পরিণত হয়েছে তখন আমরাও তাদের ওপর পবিত্র আমানত ও আস্থা রেখে সুষ্ঠু নিবার্চন দিয়ে সংকট উত্তরণ করতে পারি।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment